অতি প্রাকৃত শক্তির উপাসনা করা মানুষের প্রাচীনতম আচারের অংশ। মানুষ যখন থেকে মানুষ হয়ে উঠেছে তখন থেকেই অলৌকিক সত্বার কল্পনা করা তার প্রতি পুর্ন অনুগত্য প্রদর্শন মানুষের জীবনের অংশ। খুব সম্ভবত নিজের অন্তর্নিহিত ভয়ের বহির্প্রকাশ থেকেই যাবতীয় আধিভৌতিক চর্চার জন্ম। মানুষের যাপিত জীবিনের একটা বড় অংশ জুরে আছে এই প্রথা। কখনো শুভ কখনো অশুভ রুপে ।
আধিভৌতিক শক্তির এই উপাসনা মানুষ করে গেছে ।তার সভ্যতার অজস্র অগ্রগতির পাশে হাত ধরেই চলেছে ব্যাখ্যার অতীত কিছু মানবীয় আবেগ। মানুষের অশুভ শক্তি উপাসনার কিছু কথা আজকে বলব।
প্রকৃতির মতই মানুষেরও দ্বৈত আছে। সে সত্বার প্রবল্যই জন্ম দিয়েছে ভালো মন্দ, আলো অন্ধকার, ঈশ্বর শয়তানের। শয়তান উপাসনা বা স্যাটানিজম এমন একটি শব্দ যা মানুষের আদিম বিশ্বাসের সাথে জড়িত। যাতে সাধারণভাবে শয়তানের ওপর ভক্তি বা প্রশংসাকে বোঝানো হয়ে থাকে। হিব্রু বাইবেল অনুসারে যে মানুষের বিশ্বাসের ওপর আঘাত করে সেই শয়তান। গ্রিক নিউ টেস্টামেন্টে আরো বিস্তারিত ধারণা পাওয়া যায়, যেখানে যিশুর প্রলুদ্ধ হওয়ার ঘটনাকে বুঝানো হয়েছে। আব্রাহামিক ধর্মে শয়তানকে তুলনা করা হয়েছে বিপথগামী দেবদূত বা দানব হিসেবে যে মানুষকে খারাপ কাজ বা পাপ করতে অনুপ্রেরণা যোগায়। মানুষ শয়তান এবং ঈশ্বরের ধারনা সৃষ্টি করেছে মূলতঃ নিজেকে দায়মুক্তি দেয়ার উদ্দেশে।
হায়ারোগ্লিফিক্স এ সেটের উপাসনাঃ
প্রাচীন মিশরে খৃস্টপুর্ব ৫০০০ অব্দে থেকে শয়তান উপাসনার কথা পাওয়া যায়। শয়তানের প্রতিভু সেট/সেথ ছিলো মৃত্যু, জ্বলন্ত সুর্য। ক্ষুধা,তৃষনা, বিশৃ্ংখলা, হিংস্রতা ঘৃনা আর অশুভের দেবতা। মিশরীয় পুরানে সেট একজন ক্রোধ সম্পন্ন শক্তিমান ভীতিকর দেবতা যিনি দক্ষিনের থিবস নগরীর রক্ষক। রুক্ষতা খরা অজন্মার প্রতীক সেট ছিল এক ভয়ের চরিত্র। ধংশ আর মানুষের ক্ষতির প্রধান কারন হিসাবে দায়ি করা হয় সেটকে। থীবসে সেটের মন্দিরে উপাসনায় কুখ্যাত পুরোহিত্রা ডেকে আনতে পারতো ভয়াবহ বিপর্যয়। মিশরের তানিশ শহরে সেটের প্রকান্ড মন্দিরে যুদ্ধ দেবতা রুপে তাকে পুজা করা হতো। সেথ এর অশুভত্ব সত্ত্বেও প্রাচীন মিশরের ফারাওগন সেথ- এর উপাধি গ্রহন করতেন। মজার ব্যাপার মিশরীয় অশুভের প্রতীক সেটের সাথে ইহুদী একেশ্বরবাদের জীহোভার অনেক স্থানে মিল রয়েছে।
উপরের ছবিতে মধ্যে জন নারগেল।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় শয়তানের উপাসনাঃ ৪০০০ খৃস্টপুর্বাব্দে মেসপটেমিয়ায় ধারবাহিক ভাবে সর্ব প্রথম বসতি গড়ে তোলায় নেতৃত্ব দেয়া সুমেরিয়রা।সুমেরিয়দের ধারাবাহিকতায় খৃস্টপুর্ব ৩০০০ অব্দে আক্কদিয়রা প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় এসে মেসোপটেমিয়ায় এসে বসতি গাড়ে। এরাই ব্যাবিলনিয়ান,আশিরিয়ান পরবর্তিতে ইহুদী ও আরবদের পুর্ব পুরুষ। এনলিল ইয়া অন্যন্য ভালো দেবতার পাশাপাসি মেসপটেমিয়ার শয়তান উপাসকরা উপাসনা করতো প্লেগ আর মৃত্যুর অশুভ দেবতা নারগালের। নারগল দেখতে ছিলো কুকুরের মাথা,মানুষের দেহ, ঈগলের পা আর সিঙ্ঘের থাবার সংমিস্রনে তৈরি বিকট এক দানব। প্রাচীন নিনেভ,ব্যাবিলন আর আশুর নগরের ধংসাবশেষে এখনো অসংখ্য ভীতিকর মুর্তি দেখা যায়। মেসোপটেমিয়া মানুষ হর্ডস নামের এক অপদেবতারও উপাসনা করতো। সুমেরীয়রা লামেসতু নামের একটি খারাপ দেবতার উপাসনা করতো যার সাহায্যে সদ্য প্রসুত শিশুদের মৃত্যু কামনা করা হতো।
প্রাচীন ফিনিশিয়রা (লেবানন) উপাসনা করতো “ম্যামন ” এর। হিব্রু বাইবেলে “ম্যামন” হচ্ছে ধন সম্পদ আর প্রাচুর্য নিয়ন্ত্রকারি শয়তান।
হিব্রুদের শয়তানঃ
সেমেটিক জাতিদের মধ্যে মানব ইতিহাসে হিব্রুদের অবদান অনেক। বিশেষ করে নৈতিকতা ও ধর্ম সংক্রান্ত ব্যাপারে। তবে ওল্ড টেস্টামেন্টের যুগের প্রারম্ভিক দিকেও ধর্মে শয়তানের কোন ভুমিকা নেই। এখানে ঈশ্বরই সর্বেসর্বা অর্থাৎ কর্তার ইচ্ছা কর্ম। সে যুগের মানুষের চেষ্টা ছিল ঈশ্বরকে সব সময় তুষ্ট রাখার অপ্রাণ চেষ্টা করা। ঈশ্বর প্রসন্ন থাকলেই দেশ সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে কেবল ভালো বা শুভ পরিস্থিতি বিরাজ করবে আর কোন কারনে ঈশ্বর অসন্তুষ্ট হলেই মানুষের উপর ঈশ্বরের অভিশাপ ধেয়ে আসে এটাই ছিল সে যুগের প্রচলিত বিশ্বাস।
সেসময় শয়তান হিসাবে যাকে মোটামুটি গুরুত্ব দেয়া যায় সে হচ্ছে বাআল হাবাদ। ক্যানানাইটদের বেশির ভাগ এই উর্বরতার দেবতা বাল এর উপাসক ছিলো আর হিব্রু দেবতা জিহোভা প্রধান প্রতিদ্বন্দী হওয়ায় বাআল কে ইহুদি ও খৃস্টান ধর্মে শয়তানের একজন অন্যতম প্রতিভু আখ্যা দেয়া হয়। যা পরে ইসলামও গ্রহন করে। বাইবেল মতে বিল জীবাব নামের শয়তান যার নামের অর্থ “মাছির রাজা” বাআল হিসাবে প্রাচীন প্যালেস্টাইনে উপাসিত হত।
আধুনিক যুগে শয়তান উপাসনাঃ
আধুনিক স্যাটানিজম প্রথম সবার নজরে আসে ১৯৬৬ সালে শয়তানের চার্চ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।আধুনিক শয়তানের দলগুলো নানা ভাগে বিভক্ত হলেও প্রধান দু’টি ধারা হচ্ছে আস্তিক স্যাটানিজম ও নাস্তিক স্যাটানিজম। আস্তিক শয়তানের দলগুলো শয়তানকে পূজা করে একটি অতিপ্রাকৃতিক দেবতা হিসেবে যিনি প্রকৃতই দয়ালু।অন্যদিকে নাস্তিক শয়তানের দলগুলো নিজেদের নাস্তিক মনে করে এবং শয়তানকে মনে করে মানুষের খারাপ বৈশিষ্ট্যের একটি প্রতীক হিসাবে।
আস্তিক স্যাটানিজমঃ আস্তিক স্যাটানিজম-এ যা প্রাচীনপন্থী বা আধ্যাত্বিক স্যাটানিজম নামেও পরিচিত, শয়তানকে দেবতা হিসেবে উপাসনা করা হয়।আস্তিক স্যাটানিজমকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, যাতে কালো যাদুর উপর বিশ্বাস স্থাপন যা শয়তানকে পূজার মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে। আস্তিক স্যাটানিজমে শিথিলায়নের রীতি এবং আত্নার উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্ত। আস্তিক স্যাটানিজম প্রাচীন সূত্রগুলো থেকেও অনুপ্রেরণা লাভ করে (১৯৬০ সালের স্যাটানিক বাইবেল-এর আগের সূত্র) যেমন ১৮৬২ সালের বই ’’স্যাটানিজম ও ডাকিনীবিদ্যা’’। আরেকটি দলকে আস্তিক স্যাটানিজম ভাগে ফেলা যায়, যাদের নাম ’’বিপরীত খ্রিস্টান’’।এই শব্দটি একটি খারাপ শব্দ হিসাবে করে অন্যান্য আস্তিক শয়তানের দলগুলো। খ্রিস্টানরা অভি্যোগ করে যে বিপরীত খ্রিস্টানরা ব্ল্যাক মাস-এর চর্চা করে থাকে ।
নাস্তিক স্যাটানিজমঃ
নাস্তিক স্যাটানিজম একটি ধর্ম যা লাভেয়ান স্যাটানিজম নামেও পরিচিত।১৯৬৬ সালে আন্তন লাভেয়ান এই ধর্ম প্রচার শুরু করে। এর শিক্ষা গুলো আত্নকেন্দ্রিকতা, স্বভোগ ও চোখের জন্য চোখ নৈতিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। আন্তন লাভেয়ান শয়তানের দলেরা নাস্তিক এবং অজ্ঞেয়বাদ-এ বিশ্বাসী, যারা শয়তানকে মানুষের সহজাত সুপ্ত প্রবৃত্তির প্রতীক মনে করে। নাস্তিক শয়তানের দল একটি ছোট ধর্মীয় দল যারা কোন ধরণের বিশ্বাসের সাথে জড়িত নয় এবং যার সদস্যরা নিজের ইচ্ছা পূরণে সচেষ্ট থাকে, বন্ধুদের প্রতি সদয় থাকে ও তাদের শত্রুদের আক্রমণ করে।তাদের বিশ্বাসগুলো স্যাটানিক বাইবেল-এ লিপিবদ্ধ যা শয়তানের চার্চ দেখাশোনা করে।
শয়তানকে র্যাংকিং অনুযায়ি বিভিন্ন নামে ডাকা হয় যেমনঃ- লুসিফার, বিল জীবাব, মোলোখ, ম্যামন, আজাজেল, অ্যাস্মোডিয়াস এরা নিউ টেস্টামেন্টের বিভিন্ন স্তরের ক্ষমতা অনুযায়ি শয়তান।
ইসলামে শয়তানের নাম রাখা হয়েছে “ইবলিশ”,ইসলামে “ইবলিশ” চিত্রিত হয়েছে ঈশ্বরের পরে সব চেয়ে বেশী শক্তিশালী ক্ষমতাধর ব্যক্তি চরিত্রে। প্রাচীন আরবের উর্বরতারর ও ভাগ্যের দেবী ত্রয় লাত উজ্জা মানত ইসলাম ধর্ম অনুযায়ি শয়তানের অংশ। শয়তান এদের মাধ্যমেই একবার ইসলামের পয়গম্বরকে বিভ্রান্ত করেছিলো।
পরবর্তিতে মধ্যযুগে এক সময় নাইট টেম্পলারদের বিরুদ্ধে সলোমনের প্রথম মন্দিরের নীচে আবিস্কৃত ধংশাবশেষ এর কাছে শয়তান উপাসনার অভিযোগ ছিলো।
Post a Comment
0 comments
Dear readers, after reading the Content please ask for advice and to provide constructive feedback Please Write Relevant Comment with Polite Language.Your comments inspired me to continue blogging. Your opinion much more valuable to me. Thank you.
Click to see the code!
To insert emoticon you must added at least one space before the code.